Sunday, September 22, 2019

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়






অসাড়লিপি  




সরে এসো, বেরিয়ে বা যতদূর ছিটকে যাওয়া যায় 
বাইরের সমস্ত জল রাস্তা ও নদীর গায়ে বর্ণনার ভূত 
আমার সমগ্র ভাষা, ভ্রমবিশ্ব, ভ্রমণের সহজ 
বস্তা ঠাসা জাহাজের সমুদ্র কল্পনা 
আদা বহনের গাধা, পাহাড় কল্পনা 
শ্বাসকষ্টের ভাষা ব্যাকরণমূলক 
বাড়ি ফিরে আবিষ্কার সব এক 
কোথাও তেমন কিছু লেগে নেই 
বদলের সম্ভাবনা দ্বীপের শরীর 
অস্পষ্ট ঘোড়ার মত কুয়াশায় ছাপ রেখে যায় 


কেউ তো শরীর চেয়েছিল! প্রজননে অক্ষম প্রকৃত দেহের মধ্যে পুঁতে রেখেছিল সহজবীজ অসমর্থ অসমর্পিত চারণভূমি এই ভাষা, কাকে বলে স্বীকৃতি? স্ত্রী-দেহ স্পর্শ মাত্রই নিভে যায়, জেগে ওঠে মুখগহ্বরহীন একটা মাথা বাতাসকে ভয় পাওয়ানো মুখোশ রাস্তায় নামার কথা ভুলে যাওয়া রাগ পুষে ব্যক্তির পা-ছোঁড়া আর্থ-সামাজিকতা থেকে দূরে এই মর্ম তুলে রাখা আশ্চর্য অভ্যেস এই বৃত্তাকার দিন, কাকেদের মাংস প্রবণতায় নেমে আসা আচমকা সময়ের গায়ে বিজ্ঞাপিত বেঁচে থাকায় কয়েকটা সামান্য ছিদ্র রাত ঢুকে শান্ত করে দেবে! 


আর ছিটকে উঠবে আমার সমস্ত মুখ ঘোরাবার চেষ্টা 
ছিটকে উঠবে বিরাট রোমশ বাদুড় 
ছিন্নভিন্ন করে দেবে আমার দারিদ্র্যের মুখ 
আমি বিশাল পাথরের চাঁইয়ের নাম দেব পরিশ্রম
তার গায়ে দুর্বল বাটালিতে কুঁদে রাখব অপঠিত শিলালিপি  
আর তার উপর নেমে আসছে অবশ্যমভাবী নদীকৃষ্ণ রাত্রি 
তার শুষ্ক প্রবাহের উপর আমরা 
এই দেশ বা কখনও না হওয়া মাতৃভূমি 
পাথরের এই যে ভ্রমণ 
এই ক্রমশ সরু হয়ে ওঠা রাস্তা 
এখানে মাটির গন্ধের মধ্যে আঙুল চালাই 
কেউ বুঝি ধরে ফেলে এই দিনের শেষ বা পাথরের গভীর 
ডেকে দিচ্ছে ক্রোধের অপ্রকাশ 
একধরণের আবছা বিভা প্রৌঢ় সমকামী পুরুষ ও তার কুকুর 
সুদীর্ঘ অবিধবা মেয়েদের স্নানদীর্ঘ নিঃশাস 
তরুণী কৃষকপত্নীর দশকব্যাপ্ত গর্ভ 
একই সুড়ঙ্গ জুড়ে এগিয়ে যায় 
জল ও আমাদের সমস্ত মানুষ 
একসঙ্গে পেরিয়ে যায় বিন্দু বর্তমান 
ঢুকে যায় আরো দীর্ঘ ভবিষ্যতে
এক মরুপ্রতীম হলুদ সময়ের কণায় 
বেড়ে ওথে ছায়াহীন অন্ধত্বপ্রবণ মুক্তাঞ্চল 
আমাদের নিমরাজী দিনের সঞ্চয় 


এভাবেই কি দিনগুলো ঢুকে আসবে মাসের শরীরে? 
তুমি বসে থাকবে ট্যাক্সি না পাওয়া রোদের রাস্তায়? 
আবিষ্কার কোথায় থাকবে ভাবতে বসে 
দেখে নেবে কীভাবে উজ্জ্বল বেড়াল তার থাবা থেকে 
                    চেটে নেয় সম্ভাবনা 
অনন্ত ঘুমের মধ্যে মহাদেশ পারাপার করে যাবে ছেঁড়া ভেলা 
কৃষকের জমি ছেড়ে কারাখানার উড়ন্ত স্বদেশ 


রেখে দিই একধরণের লোভ 
রাত ও তার শোনার মত কান 
আসলে ভাষা ছাড়া অন্য কিছু 
দেশ বলে মেনে নিতে পারি না 
আমার ভাষার গায়ে সেঁটে দেওয়া 
অস্পষ্ট তালি বা ফুলে ওঠা ভারতীয়ত্ব 
আসলে পচে ওঠা মাংসের ডেলা 
নদী বা অন্যান্য সংস্কারে ভেসে যাচ্ছে 


তার সুডৌল মুখ গাঢ়, হাসিহীন 
শব্দকল্প ভেদ করে মাংসে বিঁধে আছে 
অথচ কোনও সুর সম্পূর্ণ অচেনা 
ফেলে রেখে গেছে 
পরিত্যক্ত কাঠের অক্ষর 
কখনও যাইনি আমি শুধু নিঃশ্বাসের ছাই
ঝলসে দিয়েছে নিজস্ব রাতজাগা কাঁটাঝোপ 
তার বেগুনী ফুল 
এরপর না ফেরার রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকছে 
দীর্ঘ বাহু বাংলা ভাষা        অক্ষরবিহীন 
দাঁড়িয়ে উঠেছি নদী সংগ্রহে 
স্পষ্টতর দিন আমাকে শেখাচ্ছে 
রাত ও তার বটের ঝুরি আঙুল 
আমাকে স্পর্শ করছে 
জানি এই জাতি ধর্মাচরণ ছাড়া আর কিছু স্মরণে রাখে না 
আমার মাতৃকতার সঙ্গে নদী জুড়ে থাকলেও 
আমি সহজে তার ঢেউয়ে বসিয়ে দিয়েছি বিস্মরণ 
যারা যা বুঝিয়েছে আমি মেনে নিয়েছি
দীর্ঘ বর্ষণের রোঁইয়া ওঠা অ্যাসফল্ট 
আমাকে ভুলিয়ে রেখেছে 
রূপমঞ্জরিত হত্যাগুলি 


অথচ হত্যার মধ্যে নিজেকে রেখেছি 
সাজানো মাংসের প্রতি 
মাতৃভাষাহীনতার ফ্যাকাশে 
প্রতিদিন রেখে দেওয়া আয়না 
পারা উঠে যাওয়া দুপুরের খেলা 
নিজেকে দূরত্বে রেখে 
সবরকমের ক্ষমতাহীন আস্ফালন 


আমি মনে করেছি তোমার পোড়ানো ফসল স্পর্শ করা গেছে ছোঁয়া গেছে গ্রীষ্মের বছর, স্তব্ধ হয়ে থাকা আবাদ বা সোনার লিরিক জিভে দুপুরের আচমকা আমের টক শীর্ণ হাত নুন-প্রার্থনায় মেলে দিয়েছি তবু পান্তা ফুরনো ফ্যাকাশে আমার শিকড়ে নিয়তের প্রতি-শব্দগুলো  প্রতি-হত-মানুষের মুখোশ ফুলে ফেঁপে ভরিয়ে দেয় বাড়ি ফেরা এলিয়ে থাকা রোদের জিভ 


আর এখানেই ফিরে আসে নিজের জিভ চিবিয়ে খাওয়া কৃষক 
এখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন দাশরথি রায় 
ক্রমশ সখাত সলিলে বিম্বিত হয়ে ওঠা সহজ ও আমার আলোড়ন 
বৃত্তাকার ঢেউয়ের ব্যাসার্ধে 
হয়ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোনও ভেজা ঘুড়ি 
ওড়ানোর জেদে কালরূপী জলের প্রকট হত্যা 
একধরণের রজ্জুভ্রমের সাপ 
আমাকে স্পষ্ট নির্দেশ করছে সেই পূর্বপুরুষ বা মহিলা 
তাঁর প্রথম কালো মাতৃসাধনার সময় 
রুটি ও মদের গন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মাংসের অপেক্ষা? 
দাশরথি তাঁর পাঁচালির আখড়ায় বলছেন 
কালজয়ী হবার চেষ্টা হল পাথরের গায়ে ডিম ছুঁড়ে মারা


রাস্তা ও শিথিলতা ক্রমশ সর্পিল 
উপর থেকে দেখলে স্পষ্ট হয় 
এক মাঝবয়সী থলথলে পুরুষ 
কাঁধ ঝুঁকিয়ে চলা বৃদ্ধ কবির সঙ্গে 


সমস্ত নতুনের নাম বিস্মরণ 
আমাদের নদীর দেশে মাটি না পোড়ালে 
সামান্য স্থায়ীত্বও পায় না 


1 comment:

  1. দাশরথি তাঁর পাঁচালির আখড়ায় বলছেন
    কালজয়ী হবার চেষ্টা হল পাথরের গায়ে ডিম ছুঁড়ে মারা
    উফ্‌, কী মারাত্মক! এই মহাকবিতা অবশ্য আমাদের পাথুরে অসাড়তার গায়ে ডিম ছুঁড়ে টের পাওয়াচ্ছে আগামী বাংলা কবিতার বৈজয়ন্তীর আভা।

    ReplyDelete