Wednesday, September 25, 2019

সম্পাদকীয়





মেনে নিচ্ছি। আপনিই একমাত্র। একমেবাদ্বিতীয়ম। বিশ্বের প্রথম এবং শেষ কবি। আপনার অঙ্গুলিলেহনেই নির্ধারিত হয়েছিল ব্যাসদেবের ভবিষ্যৎ। আপনার পছন্দই শেষ কথা। আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়াই কষ্টিপাথর। কে সোনা আর কে ঝুটো সোনা, তা একমাত্র আপনিই বলে দিতে পারেন। এক পংক্তি পড়েই বা সবচেয়ে ভালো হয় না পড়েই আপনি নিদান দিতে পারেন ইনি কবি নন বা ইনি কবি। আসলে ব্যাপারটি হল, আপনার মতো কবি বা লেখকের সংসর্গই আসল কথা। সঙ্গদোষ না থাকলে তো আপনার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হবে সেই কবি বা লেখক। কিন্তু যাঁরা আপনার নেকনজরে, তাঁরা পায় আপনার সর্বগ্রাসী প্রতিভার বিচ্ছুরণ। সেই আলোয় তাঁরাও আলোকিত হন। আপনিই সূর্য। বাকি সব চন্দ্র। আপনার আলোয় তারা আলোকিত। আর আপনার আলো? সে তো স্বয়ম্ভূ। সে তো নিত্য ছন্দের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গই তো নির্মাণ করে আপনাকে।

আপনিই পারেন বুঝে নিতে কারা কারা লেখার যোগ্যতাহীন আর কারা কারা যোগ্য। আপনি ইতিহাসের সর্বস্ব প্রান্তকে নির্মাণ করেন নিজ হাতে। আপনি সময়, আপনি কবি, আপনি ঈশ্বর এবং আপনিই সমালোচক। আপনি যদি বলেন কেউ কবি, তবে সে কবি। আপনি যদি বলেন কেউ অকবি, তবে সময়েরও সাধ্য নেই তাকে কবি করে।

মেনে নিচ্ছি, আপনি এক। 'বহু'-র সমস্ত বৈচিত্র আসলে মায়া। যেমন সব রঙ মিলেমিশে সাদা হয়ে যায়, তেমন আপনার সমস্ত বহু মিলেমিশে আপনার মধ্যেই এক হয়ে যায়। আপনি বিচারক, আপনি আসামী, আপনিই মহাকাল আবার আপনিই আলো। অন্ধকার আপনার মধ্যেই মিশে গিয়ে বিলীন হয়ে যায়। আপনি মৃত্যুকে ভয় পান না, কারণ জানেন, আপনিই স্বয়ং মৃত্যু। বিলীন তো আপনি নিজের মধ্যেই হচ্ছেন। আর সৃষ্টি হচ্ছে আপনার নতুন আপনি।

আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আপনার নিদান, পছন্দের সোচ্চার ঘোষণা এবং বিচারের কর্কশ আত্মপ্রচারের আলো থেকে বেরিয়ে আমরা প্রমিথিউসের মতো সামান্য হলেও বিদ্রোহী। আমরা এক নয়, বহুতে বিশ্বাসী। আমরা সত্য নয়, সত্যের বিভিন্ন স্তরে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি সমস্ত কিছুই জায়মান, পরিবর্তনশীল, বহু এবং মহাসময়ের সামনে নতজানু। আমরা অবিনশ্বর নই।
আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন হে কবি, মেনে নেব, সমস্তই, শুধু একটু শান্ত হোন।

এসেছে উৎসবের মরশুম। এক কদর্য আত্মঘোষণা এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ম্বরে নিজের দীনতা প্রকাশের এক সময়। প্রকৃতি যেমন উৎসবমুখর, তার ছিটেফোঁটা নেই মানুষের মধ্যে। প্রকৃতি এই সময় বহুকে আপন করে মিলনে ব্যাপৃত। তার সুরে প্রতিধ্বনিত হয় নিরভিসন্ধির ছন্দ। কিন্তু মানুষের সমাজ আর প্রকৃতি বড় বিপরীতমুখী হয়ে চলেছে। একদিকে ফ্যাসিবাদ তার হিংস্র দাঁতনখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আর অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি, কদর্য সংস্কৃতির নানা রূপ। অগ্রজ শিল্পী ঊর্মিমালা বসুকে নিয়ে ফেসবুকে যে নিম্নরুচির ফ্যাসিস্টরা আক্রমণ করল, আমরা তার তীব্র নিন্দা করি। এর শাস্তি অবশ্যই সময় তাদের দেবে। কিন্তু সময় নিজ হাতে ঘাতক নয়। মানুষ, সময়ের হাতিয়ার। মানুষকে মাঝেমাঝে সময়ের দূত হয়ে যেতে হয়। যাদবপুরের অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ছাত্র-আন্দোলন আরও রূপ পাক। তাঁদের সমর্থন করি।

মৌলবাদের এই সামগ্রিক আবর্তের মধ্যে বহুত্ববাদের উপাসনা করা খুব কঠিন। কিন্তু আমরা এই বহুত্ববাদকেই, ধারণ করতে চাই আমাদের সমস্ত কাজে। আমাদের একটা কথাই ঘোষণা করার। আমাদের কোনও ধর্ম নেই। ইতিহাস রয়েছে।
আমাদের কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম কবি বা রাজা বা শাসক নেই।
আমাদের রয়েছে বহুস্তরের, বহুস্বরের এক পৃথিবী।
আমাদের কোনও তথাকথিত সত্য নেই।
রয়েছে আধ্যাত্মিকতা। এমন এক সংযোগ, যা মানুষকে ছড়িয়ে দেয় অজস্রে।

এ পৃথিবী মৌলবাদ মুক্ত হোক। অশুভশক্তি ধুয়ে মুছে যাক। মানুষ সহিষ্ণু হোক। আত্মদীপ জ্বলে উঠুক নিভৃতে।

ভালো থাকুন।



সম্পাদকমণ্ডলী- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী শমীক ঘোষ




যোগাযোগ- abahaman.magazine@gmail.com

2 comments: