Monday, September 23, 2019

বেবী সাউ - পিতৃপরিচয় ( একটি সম্পূর্ণ কাব্যপুস্তিকা)












পিতৃপরিচয়

১.
খুব ভোরে, 
সারা বাড়ি নিস্তব্ধদু'একটা পাখি জেগেছে কী জাগেনি 
তখনই বাবা ঘুম থেকে উঠতেন 
সঙ্গোপনে মেলে ধরতেন সংসার,  গুরুত্বপূর্ণ ফাইল... 

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন হিসেবের শরীর

কপালের ভাঁজে জমে আমাদের পাওয়ানা-পাওয়া,  
চাওয়ানা-চাওয়া

সোনালি রোদ এসে পড়ত উঠোনে 
রোদ বাড়তবেড়েই যেত 

জমানো ভাঁজগুলো পেতে দিতেন খোলা রোদে
ভোরের নরম ভাঁজে কাক মুখ দিতে পারে ভেবে 
মশারি টাঙিয়ে রাখতেন মা...

বেলা পড়লে সেইসব শুকনো ভাঁজ
আমরা মুচমুচে পাপড় ভেবে 
জলযোগ সারতাম... 




২. 
একদিনচুপিচুপি খুব ইচ্ছে হল 
বলিরেখার  কারণ খুঁজে বের করি 

ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছিশিবঠাকুরের কপালে ধূসর তিনটি ভাঁজের ইতিহাস, 
কণ্ঠনালি উঁচু...

ঠাকুমা বলতেনবাসুকীর বিষ জমে আছে...  হজম হয় না..হজম হয় না... সারা জীবনের জ্বালা... 

বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতামকণ্ঠনালি উঁচু... কপালের বলিরেখা
শিব ঠাকুরের মত... 

শুধু সেই সংখ্যা তিন ছাড়িয়ে পাঁচে পৌঁছে গেছে... 



৩. 
বাবা ঠিক আমাদের চারপাশটির মতো... 

যখন কোনও কবি প্রকৃতিকে নিয়ে কবিতা লেখেন
আমি তার মধ্যে বাবাকে মেলাতে বসি 

প্রকৃতির মত তিনি নির্লিপ্তশান্ত এবং অসহায়...  








৪. 
আমার বাবার নামশ্রী নগেন্দ্রনাথ সাউ। 
কিন্তু আমাদের গ্রামে সবাই ডাকে 'মাস্টারদা'... 

আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বিষবৃক্ষ পড়ছি

নগেন্দ্র'র প্রতি শিশুমনে ঘৃণা জমাট বাঁধছে
আর লক্ষ্মীমন্ত মায়ের জন্য করুণা 

বাবাকে আমি তখন কিছুদিন 'মাস্টারদা সূর্যসেনভাবতাম... 



৫. 

বাবা আর আমিআমি আর বাবা 
দু'জনকে দু'জনে এড়িয়ে চলি... 

যেন দুটো শত্রুজাত দেশ 
সীমারেখা নিয়ে পরমাণু বোমা বানাতে শিখেছে 

আমাদের সেই অমীমাংসিত,  অপ্রয়োজনীয় ল্যান্ড লাইন মাঅসহায় 

চুপচাপ দৃশ্য দেখেন 





৬. 
বাবা অঙ্কে তুখোড় ছিলেন... 
যেকোন গণিত এখনও মিলিয়ে দিতে পারেন মুখে মুখে... 

সন্ধেবেলাঅবসন্ন সংসার যখন একাধিক কোলাহলে নিজের অবসর খুঁজত 

আমার বেচারা বাবাআমাদের অঙ্ক শেখাতে বসতেন... 

দেখতামএকটা দিকভ্রান্ত মানুষ দুই প্লাস দুই মেলাতে গিয়ে 
একটা আকাশএকটা নদী এবং মাছের ছবি এঁকে ফেলেছেঅজান্তে... 



৭. 

পুতুল খেলাকে খুব ঘৃণা করতেন... 

বাবা বাড়ি ফেরার আগেইপুতুলের রান্নাপাতিসংসার লুকিয়ে ফেলতাম 

সব জেনেও কিছু না জানার ভান করতে করতে 
বাবা নিজেই একটা বিরাট খেলার সংসারে ঢুকে পড়েছেন 

নিজেই জানেন না 










৮. 
বাবার দুঃখের নাগাল কখনও পেতাম না আমরা... 

শুধু দেখতাম বাইরের কেউ এলে 
বিষন্ন বাবা অধিক বিষন্ন একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে 
আতিথ্য গ্রহণ করছেন 

যেন এই বিশাল পৃথিবীতে একা একজন মানুষ 
বহু বহু কাল গৃহহীন... 

বোধির লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছে 



৯. 
বাবা সবসময়ই বলেন, ' আপ ভালো তো জগত ভালো... " 

আর এই আপ্তবাক্যটিকে সত্য প্রমান করার জন্য 
প্ররোচিত পৃথিবী বারবার সুযোগ গ্রহণ করেছে... 
বারবার জয়ী হয়েছে... 

আর বাবাকে ত্যাগ করতে হয়েছে 
খুনহিংসা এবং দ্বেষ 



১০. 

বরাবরই রহস্যময় লেগেছে তাঁকে... 

কিছুতেই ছোঁয়া যায় নাকিছুতেই নাগাল পাওয়া যায় না...

আমার মধ্যেও প্রচণ্ড রকম জেদ চেপে বসে 
অনুসরণ করতে করতেপিছু ধাওয়া করতে করতে

একদিন দেখিআসলে তেমন কিছুই ছিল না রহস্যের 

যাতেসমাধানের জন্য মেয়ে থেকে
আমাকে মা'তে নামতে হতে পারে! 



১১. 
মায়ের কাছে বাবাকে সবসময়ই ম্রিয়মান লেগেছে... 

মায়ের রূপ ঠিক দূর্গা ঠাকুরের মত
কথাবার্তা সরস্বতীর মতন 
আর প্রতিটি শাসন যেন,  মা চামুণ্ডা... 

তাঁর কাছে অনুজ্জ্বল বাবা আমার... ভিখারী,  ভিখারীর ভিখারী যেমন... 













১২. 

বহুদূরের সূর্যাস্ত ভেঙে
বাবা ঘরে ফিরতেন 
পা ভর্তি ধুলো 

চেইন খুলে যাওয়া সাইকেল 
চাকায় চাকায় ঘুরত সময়কাল 

ভ্রূক্ষেপহীন মা এক ঘটি জল এনে ঢেলে দিতেন তার টায়ারে

সময় দাঁড়িয়ে থাকত ঠায়

বাবা চুপচাপ ঘরে ঢুকে যেতেন 











১৩. 
নির্দল পার্টির মত ছিল বাবার অবস্থান 

একদিকে জমিদার মেজাজী আমার দাদুখাঁটি কংগ্রেস 

অন্যদিকে আমার জেঠু ছিলেন সাচ্চা কমরেড...  

দাদু অসহায়ভাবে চেয়ে থাকতেন বাবার দিকে 

আর একদিকে বাবা অন্যদিকে দাদা... 
গৃহযুদ্ধ এড়াতে  
সবসময়ই এক দলহীন ভারতের স্বপ্ন দেখে গেলেন...




8 comments: