পিতৃপরিচয়
১.
খুব ভোরে,
সারা বাড়ি নিস্তব্ধ, দু'একটা পাখি জেগেছে কী জাগেনি
তখনই বাবা ঘুম থেকে উঠতেন
সঙ্গোপনে মেলে ধরতেন সংসার, গুরুত্বপূর্ণ ফাইল...
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন হিসেবের শরীর
কপালের ভাঁজে জমে আমাদের পাওয়া, না-পাওয়া,
চাওয়া, না-চাওয়া
সোনালি রোদ এসে পড়ত উঠোনে
রোদ বাড়ত, বেড়েই যেত
জমানো ভাঁজগুলো পেতে দিতেন খোলা রোদে
ভোরের নরম ভাঁজে কাক মুখ দিতে পারে ভেবে
মশারি টাঙিয়ে রাখতেন মা...
বেলা পড়লে সেইসব শুকনো ভাঁজ
আমরা মুচমুচে পাপড় ভেবে
জলযোগ সারতাম...
২.
একদিন, চুপিচুপি খুব ইচ্ছে হল
বলিরেখার কারণ খুঁজে বের করি
ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছি, শিবঠাকুরের কপালে ধূসর তিনটি ভাঁজের ইতিহাস,
কণ্ঠনালি উঁচু...
ঠাকুমা বলতেন, বাসুকীর বিষ জমে আছে... হজম হয় না..হজম হয় না... সারা জীবনের জ্বালা...
বাবার দিকে তাকিয়ে দেখতাম, কণ্ঠনালি উঁচু... কপালের বলিরেখা
শিব ঠাকুরের মত...
শুধু সেই সংখ্যা তিন ছাড়িয়ে পাঁচে পৌঁছে গেছে...
৩.
বাবা ঠিক আমাদের চারপাশটির মতো...
যখন কোনও কবি প্রকৃতিকে নিয়ে কবিতা লেখেন
আমি তার মধ্যে বাবাকে মেলাতে বসি
প্রকৃতির মত তিনি নির্লিপ্ত, শান্ত এবং অসহায়...
৪.
আমার বাবার নাম, শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাউ।
কিন্তু আমাদের গ্রামে সবাই ডাকে 'মাস্টারদা'...
আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বিষবৃক্ষ পড়ছি
নগেন্দ্র'র প্রতি শিশুমনে ঘৃণা জমাট বাঁধছে
আর লক্ষ্মীমন্ত মায়ের জন্য করুণা
বাবাকে আমি তখন কিছুদিন 'মাস্টারদা সূর্যসেন' ভাবতাম...
৫.
বাবা আর আমি, আমি আর বাবা
দু'জনকে দু'জনে এড়িয়ে চলি...
যেন দুটো শত্রুজাত দেশ
সীমারেখা নিয়ে পরমাণু বোমা বানাতে শিখেছে
আমাদের সেই অমীমাংসিত, অপ্রয়োজনীয় ল্যান্ড লাইন মা, অসহায়
চুপচাপ দৃশ্য দেখেন
৬.
বাবা অঙ্কে তুখোড় ছিলেন...
যেকোন গণিত এখনও মিলিয়ে দিতে পারেন মুখে মুখে...
সন্ধেবেলা, অবসন্ন সংসার যখন একাধিক কোলাহলে নিজের অবসর খুঁজত
আমার বেচারা বাবা, আমাদের অঙ্ক শেখাতে বসতেন...
দেখতাম, একটা দিকভ্রান্ত মানুষ দুই প্লাস দুই মেলাতে গিয়ে
একটা আকাশ, একটা নদী এবং মাছের ছবি এঁকে ফেলেছে, অজান্তে...
৭.
পুতুল খেলাকে খুব ঘৃণা করতেন...
বাবা বাড়ি ফেরার আগেই, পুতুলের রান্নাপাতি, সংসার লুকিয়ে ফেলতাম
সব জেনেও কিছু না জানার ভান করতে করতে
বাবা নিজেই একটা বিরাট খেলার সংসারে ঢুকে পড়েছেন
নিজেই জানেন না
৮.
বাবার দুঃখের নাগাল কখনও পেতাম না আমরা...
শুধু দেখতাম বাইরের কেউ এলে
বিষন্ন বাবা অধিক বিষন্ন একটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে
আতিথ্য গ্রহণ করছেন
যেন এই বিশাল পৃথিবীতে একা একজন মানুষ
বহু বহু কাল গৃহহীন...
বোধির লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছে
৯.
বাবা সবসময়ই বলেন, ' আপ ভালো তো জগত ভালো... "
আর এই আপ্তবাক্যটিকে সত্য প্রমান করার জন্য
প্ররোচিত পৃথিবী বারবার সুযোগ গ্রহণ করেছে...
বারবার জয়ী হয়েছে...
আর বাবাকে ত্যাগ করতে হয়েছে
খুন, হিংসা এবং দ্বেষ
১০.
বরাবরই রহস্যময় লেগেছে তাঁকে...
কিছুতেই ছোঁয়া যায় না, কিছুতেই নাগাল পাওয়া যায় না...
আমার মধ্যেও প্রচণ্ড রকম জেদ চেপে বসে
অনুসরণ করতে করতে, পিছু ধাওয়া করতে করতে
একদিন দেখি, আসলে তেমন কিছুই ছিল না রহস্যের
যাতে, সমাধানের জন্য মেয়ে থেকে
আমাকে মা'তে নামতে হতে পারে!
১১.
মায়ের কাছে বাবাকে সবসময়ই ম্রিয়মান লেগেছে...
মায়ের রূপ ঠিক দূর্গা ঠাকুরের মত
কথাবার্তা সরস্বতীর মতন
আর প্রতিটি শাসন যেন, মা চামুণ্ডা...
তাঁর কাছে অনুজ্জ্বল বাবা আমার... ভিখারী, ভিখারীর ভিখারী যেমন...
১২.
বহুদূরের সূর্যাস্ত ভেঙে
বাবা ঘরে ফিরতেন
পা ভর্তি ধুলো
চেইন খুলে যাওয়া সাইকেল
চাকায় চাকায় ঘুরত সময়, কাল
ভ্রূক্ষেপহীন মা এক ঘটি জল এনে ঢেলে দিতেন তার টায়ারে
সময় দাঁড়িয়ে থাকত ঠায়
বাবা চুপচাপ ঘরে ঢুকে যেতেন
১৩.
নির্দল পার্টির মত ছিল বাবার অবস্থান
একদিকে জমিদার মেজাজী আমার দাদু, খাঁটি কংগ্রেস
অন্যদিকে আমার জেঠু ছিলেন সাচ্চা কমরেড...
দাদু অসহায়ভাবে চেয়ে থাকতেন বাবার দিকে
আর একদিকে বাবা অন্যদিকে দাদা...
গৃহযুদ্ধ এড়াতে
সবসময়ই এক দলহীন ভারতের স্বপ্ন দেখে গেলেন...
পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি।।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDeleteবড্ড আপন কথাগুলো। জীবনের কবিতা
ReplyDeleteঅপূর্ব!
ReplyDeleteআমার কিছু কবিতা আছে,কিভাবে পাঠাবো?
ReplyDeleteপাঠমুগ্ধ
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল
ReplyDelete