বিলাসিনী কথা
খুব
ভোররাতে বাড়ি থেকে চলে আসতাম। বাবার জন্য রেখে আসতাম একটা ফাঁকা বাড়ি, একা বারান্দা,
টবের গাছ, আর একটা ধূ ধূ মাঠ। আমার ঘর জুড়ে আমার সাময়িক বসবাস-চিহ্ণ। বাবা নামের লোকটা সেই খালি বাড়িতে সেইসব
চিহ্ণ আগলে বসে থাকতো।
আমি যখন
এ লেখা লিখছি, তাতে মিশে যাচ্ছে ক’ফোঁটা বেহিসেবী জল। চারদিক থেকে প্রশংসা ও নিন্দা উড়ে আসবে; সম্পাদক বিনা দ্বিধায়
অথবা দ্বিধাযুক্ত হেসেই লেখা নিয়েছেন। জানতে পারলেন না, তিনি জল-মেশানো লেখার মালিক। ঠকিয়ে দিচ্ছি আমি সবাইকে, এমনটা হওয়ার কথা ছিলো
না! বাবা নাকি স্বপ্ন দেখতো মাঝে মাঝেই। একটা ছোটো রকমের আমি একটা অন্ধকার ঘরের
ভেতর ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ।
বাবা ডাকছে। সেই ডাক আমি অবধি পৌঁছোচ্ছে না। স্বপ্ন শুনলেই আমি বাবার বুকে-পেটে মুখ ঘসতাম। বাবা চলে যাওয়ার পর মা’র বুকে কান পেতে শুনতে
চেষ্টা করি, ওখানে বাবার শব্দ শোনা যায় কি না। পুরোনো অভ্যাসের বশে যদিও বা কখনো মনে
করে ফেলি, নির্বাসনদন্ড শেষে
বাবার শব্দ পাওয়া যেতে পারে-মাঝরাতের মতো নৃশংস খুনি মনে করিয়ে
দেয়, এ ভাবার নয়। আশায় আশায় লিখি। জলমেশানো লেখা থেকে কেউ যদি অন্তত জলটুকু
চিনে নেয়।
হয়তো হ্যাঁ। নয়তো না। কোনোও দিন তো হবে।
আমাদের প্রত্যেকের বুকেই যে
বেণীমাধব আছে ইদানীং একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। তারা কেউ কেউ নাগরিক মুখোশ খুলে কোনোও
হা-ক্লান্ত বিকেলে,
একলা জলের ধারে এখনও কি দাঁড়াতে চায়? তাদেরও
কি কখনো কখনো ভীষণ বৃষ্টি পায়? আমার জল মেশানো লেখা থেকে তারা
কি টুকরো টুকরো জলের দানা নিজের অহংকারী ঠোঁটে তুলে নেয়? নাকি
নিত্যদিন বাজারে আলু-পটলের সওদা করতে করতে তারা নিজেরাই ঝাঁকায়
উঠে বসে? সেখান থেকে দাঁড়িপাল্লায়। মুখোশের ওজন মাপতে। তারপর সিধে চালান হয়ে যায় পাঁচতারার যন্ত্র-সমণ্বিত রান্নাঘরে?
যেখানে হলুদ লাগা আটপৌরে হাতের ছোঁয়া নিষিদ্ধ। অনেক আলোর নীচে, কেজো হাসি,
কেজো চাউনির সামনে সারি সারি প্লেটে শুয়ে পড়ে তারা। তাদের মৃত্যুতে আমি আজকাল আহত হই বেকার!
মুখ
লুকোনোর ক্লান্তি বড়োই বেয়াড়া। আলোর নীচে হাঁটার আগে পা-দু’টোকে দেখি। ওদের জন্য কেমন কষ্ট হয়। এরা কতোদিন ছুটি পায়নি বলো? এইসব ভেবেই আমি ব্যথিত
চোখ রাখি রাস্তায়।
চোখের কুয়াশা-প্রেম মস্তিষ্কে পৌঁছোনোর
আগেই “এইইই সসসস্!” কেউ ভেতর থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঝলমলে শহুরে ভীড়ে। তাকে কুড়োবো বলে যেই না ঝুঁকে পড়েছি, কবাট খোলা বুক থেকে
ঘর-বাড়ির ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। ফুটপাত জুড়ে খালি বর্ষক্লান্ত ইঁট কাঠ, বালি পাথরের মৃতদেহ। অমনি থমকে গেলো নাগরিক সং-রা। অবাক হয়ে ধ্বংসস্তূপ দেখছে শহর। “দুয়ো!দুয়ো” বলে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো কেউ কেউ,
কিন্তু মুখ খুঁজে পেলো না তারা। মুখোশে মুখ আঁকতে ভুলে গেছে। বাঁ-পকেটের বুক ঘড়ি ডেকে উঠলো, “টিক্ টিক্”। ফের সবাই নিজের নিজের অন্ধকারে মুখ ঢেকে
নিলো।
এবার
তো বাড়ি ফিরতে হয়।
গলি গলি
ছায়ারা ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। সজোরে ঝেড়ে ফেলি তাদের। এগোতে থাকি বরং। শুনশান হতে হতেও যে রাস্তা একা হয় না (বুকেরই মতো)
তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যেতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে টের পাই, এটা বাড়ি নয় তো!
স্রেফ কাঠামো। একে গেরস্থালি না বলার জেদে কিছু নাম
দিই না আপাতত।
এবার স্বার্থপর
হওয়ার পালা।
মুখোশ খোলার
আগে কি আসবাবগুলো চিৎকার করেছে?
এই স্বার্থপরতা উদযাপনের একমাত্র সাক্ষীরা? এই আশ্বাসেই কিছু নরম স্মৃতিদের ছেড়ে দিলাম। লঘু পায়ে তারা আদুরে বেড়ালনী হয়ে বিছানায়
উঠলো।
তারপর ঠান্ডা
চোখ মেলে খুঁজছে ক্ষতস্থানের বর্তমান চেহারাটুকু। আমি জানি, যেতে হবে। আজ অথবা কাল। আজ এখনই যেতে চাইছি না এটুকুই বোঝাতে
আমি বেণীমাধবকে টেনে আনলাম। এবার তো শীত করবে। বাইরে গোটা শহরকে প্রতীক্ষায় রেখে আমি “আধুনিক” ,
“নাগরিক” পুরুষ নামটি ঠোঁটে তুলে নিই। জিভে জড়াই। যতোবার ঠোঁট কাটে, ত্রস্ত হাতে মেরামত
চলে।
ফিসফিসে
ফিসফিসে ঘর ভরে ওঠে।
তারা কান
থেকে ঘাড়ে ও ঘাড় থেকে বুকের সহজ রাস্তাটি বেছে নিতে চায়, বারণ করি আমি। আমার যাবতীয় ঘুম খামে ভরে ঠিকানাবিহীন
বেণীমাধবের নষ্ট চোখে পাঠানোর উদগ্র ইচ্ছেকে “কবুল” বললে টের পাই
দলা দলা বেদনা নিঃসাড়ে হত্যা করতে আসছে। পুরোনো ঘামের মতো কিছু একটা আপন একঘেয়ে
সুরে ডেকে যাচ্ছে।
দিনের অভিনয়
শেষ করে তারাও নিজের নিজের দাবি জানাতে তৎপর হয়ে ওঠে। এই অবধি ভেবে ভেবে আমি নির্বাসন কাল ঠিক
করে ফেলি।
আমার আপাতত
কিছু হবার নেই ভেবেই হয়তো মাংসল হু হু-রা কাঁধ দিতে আসে। এদের একাকিত্ব বললেই হতো, ইচ্ছে করে না। বরং “প্রেম” বলে ডাকি;
কারণ ওই নামে নষ্ট জ্বর ছাড়া কিছুই তো আঁটতে চাইছে না!
এবার
আহত করার পালা।
আহত করবো
বলে আমি প্লাস্টিক মানুষের ভেতরে একটা রাজকীয় বাঘ খুঁজি। এ দিক ও দিক, এ আঁচড়, সে আঁচড়ের পর দেখি, আসলে কেউই আহত নয়। শুধু আঘাতের গন্ধ বুকে তুলে রেখেছে। ঘেন্নায় ঠোঁট বাঁকাতে গেলেই ক্ষত চিড়বিড়িয়ে
ওঠে।
সে পরিকল্পনা
অগত্যা বাদ দিয়ে ঘেন্না পেতে অসমর্থ আমি ভালো-বাসা বানাবো ঠিক করি। এইবার পিপাসা পাচ্ছে। তাকে জোর করে ঝেড়ে ফেললাম। বুকের ভেতর যে আস্ত মর্গটা নিয়ে ঘুরছি, তার দিকে মন ফেরাই। অতএব, কাটা-ছেঁড়া শুরু করা
যাক? তফাৎ এইই, এখানে জ্যান্ত স্মৃতিদের
ময়নাতদন্ত চলে।
স্মৃতিরা
কি চিৎকার করে? কখনো ভাবিনি তো! অথবা, এমনটাও হতে পারে তাদের চীৎকৃত ধ্বনি রাত্রির বাতাসে ভর করে উড়ে যায় অন্য
কোনোও বুকের ওম্ খুঁজে নেবে বলে। তাদের আটকাবো না তো। কেউ একজন এইমাত্র স্মৃতি থেকে ভেজা হাত
সরিয়ে নিলো, ব্লেড বসালো, মুঠো করে ধরলো মুক্তির বড়ি,
চোখ বুঁজলো। আমি আটকালাম না। হয়তো আজ রাতে বেণীমাধব স্বপ্নে বাঘ হতে
চাইবে।
আমার ঘুম
নেই।
তাই চাইলেও
আমি “বাঘ” হতে পারবো না। আর এই না-হওয়ার যন্ত্রণা আমি
অনায়াসে টুক্ করে গিলে নিই।
শরীর
থেকে দূরত্ব বাড়াই।
স্পষ্ট
টের পাচ্ছি,এই যেটাকে “আমি” বলে টেনেটুনে
ফুটপাত থেকে এখানে এনে ফেললাম,ওটা আমি হতেই পারে না। আমার তো ছুটি হয়ে গেছে কবেই। আমি তো এখন কেউই নই! অর্থাৎ যে কেউ
“আমি” হতেই পারে।পারেই। হঠাৎ মনে হয় আমি সকালের অহংকারী শালিক
কেন হলাম না? অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেই মেয়েটা যাকে দেখে পৃথিবী ত্রাসে বুঝেছিলো,
সভ্যতা মানুষকে নগ্নই করে তোলে। কিন্তু আমি তো তা হইনি। অতএব ব্যর্থ আমি, অথবা আমি নই-
পরেরবার ধ্বংস হওয়া হিরোসিমার বুকে বনজ ফুল হতে চাইলাম। বেণীমাধব তুমি চিনে নিও কষ্ট করে। এসব চাওয়া থেকে দূরে যেতে হবে। অনেএএএক দূরে। হয়তো সেখানেই শেষ শিশিরের গা থেকে কোনোও
ফুলো ঠোঁট অবোধ স্মৃতিকে কোলে তুলে আমি হেঁটে যাবো কোনোও মায়াময় উপত্যকায়। সমস্ত বনজ গন্ধ বুকে করে নিয়ে যাবো। ততোদিন ছুটি চলুক?
No comments:
Post a Comment